Sunday , May 5 2024
Breaking News

পাঁচ লক্ষাধিক মুসুল্লীর জনস্রোতে পরিপূর্ণ ঐতিহাসিক শোলাকিয়ার মাঠ

ডেস্ক নিউজঃ

মুসুল্লীদের জনস্রোতে পরিপূর্ণ ঐতিহাসিক শোলাকিয়ার মাঠ। মাঠের ভেতরের কাতার উপচে বাইরেও কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় ঈদগাহ ময়দান। এবারও পাঁচ লাখের বেশি মুসল্লির উপস্থিতি ও কঠোর নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হলো কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়ার ঈদ জামাত। নামাজ শেষে মোনাজাতে বিশ্বশান্তি ও দেশের সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়া করা হয়। এটি ছিল এই ঈদগাহ ময়দানে ঈদুল ফিতরের ১৯৭তম জামাত।

বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) সকাল ১০টায় জামাত শুরু হয়। এতে ইমামতি করেন বড় বাজার মসজিদের খতিব মাওলানা শোয়াইব বিন আব্দুর রউফ।

আজ (বৃহস্পতিবার) ভোরের আলো ফোটার আগেই নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয় শোলাকিয়া ও আশাপাশের এলাকা। চার স্তরের নিরাপত্তাবেষ্টনী পার হয়ে মুসল্লিদের ঢুকতে হয় ঈদগাহ মাঠে। মাঠে প্রবেশের ক্ষেত্রে মুসুল্লিদের খানিকটা দেরি হয়। তারপরও সকাল ৯টার আগেই জনসমুদ্রে পরিণত হয় শোলাকিয়া। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে জামাতে ছাতা, ব্যাগ, লাঠিসোটা, দিয়াশলাই কিংবা লাইটার নিয়ে মাঠে প্রবেশে পুলিশের নিষেধাজ্ঞা ছিল। ফলে এসব রেখে মুসুল্লিদের ঈদগাহে প্রবেশ করতে হয়েছে।

জেলা শহরের পূর্বপ্রান্তে নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত এ ঈদগাহ মাঠে মুসল্লিদের ঢল শুরু হয় ভোর থেকেই। ঈদগাহ মুখী সব রাস্তাঘাট মুসল্লিদের দখলে চলে যাওয়ায় কয়েক ঘণ্টার জন্য শহরের সড়কগুলোতে যানচলাচল বন্ধ করে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জামাত শুরুর ঘণ্টাখানিক আগেই সাত একর আয়তনের শোলাকিয়া মাঠ কানায় কানায় ভরে যায়। মুসল্লিদের অনেকে মাঠে জায়গা না পেয়ে পার্শ্ববতী রাস্তা, তিনপাশের ফাঁকা জায়গা, নদীর পাড় ও আশপাশের বাসাবাড়ির ছাদে উঠে জামাতে শরিক হতে দেখা যায়।

অন্যদিকে নারীদের জন্য শহরের সরযূবালা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পৃথক ঈদ জামাতের আয়োজন করা হয়। সেখানেও বহু নারী ঈদ জামাতে অংশ নেন।

নামাজ শুরুর আগে মুসল্লিদের স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য রাখেন ঈদগাহ কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ ও কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মাহমুদ পারভেজ।

২০১৬ সালে জঙ্গি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়তি সর্তকর্তার অংশ হিসেবে শোলাকিয়ায় নেওয়া হয় নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সাজানো হয় পুরো আয়োজন। ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের নিরাপত্তায় ১ হাজার ১১৬ পুলিশ সদস্য নিয়োজিত ছিলেন। তাদের মধ্যে পোশাকে ৮৮০ জন, সাদা পোশাকে ১৮৭ জন ও ট্রাফিকে ৪৯ জন অফিসার ফোর্স মোতায়েন ছিল। এছাড়াও পাঁচ প্লাটুন বিজিবি, শতাধিক র‌্যাব সদস্য, আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও আনসার সদস্যের সমন্বয়ে কঠোর নিরাপত্তা বলয়ের পাশাপাশি মাঠে সাদা পোষাকে নজরদারি করে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। মাঠে ছিল চারটি ড্রোন ক্যামেরা ও মাইনো কোলারসহ ছয়টি ভিডিও ক্যামেরা। ঢাকা থেকে এসেছিল বোম ডিসপোজাল টিম। মাঠ ও শহরসহ প্রবেশ পথগুলো সিসি ক্যামেরা দিয়ে সার্বক্ষনিক পর্যবেক্ষণ করা হয়। মাঠে স্থাপিত ছয়টি ওয়াচ টাওয়ার থেকে দূরবীন নিয়ে নিরপত্তার দায়িত্ব পালন করে র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরা। সার্বক্ষনিক পুলিশের কুইক রেসপন্স টিম কাজ করেছে।

শোলাকিয়া মাঠ ও শহরের যত অলিগলি আছে, সবখানে বসানো হয় নিরাপত্তা চৌকি। তাছাড়া অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে ১০জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও দায়িত্ব পালন করেন। ঈদগাহ এলাকায় তিনটি অ্যাম্বুলেন্সসহ বেশ কয়েকটি মেডিক্যাল টিম এবং অগ্নি নির্বাপক দলও মোতায়েন ছিল। স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্বে ছিল বিপুল সংখ্যক স্কাউট সদস্য। প্রত্যেক মুসল্লিকে মেটালডিটেক্টর দিয়ে দেহ তল্লাশি করে তারপর মাঠে প্রবেশ করার সুযোগ দেওয়া হয়।

শোলাকিয়ার ঈদ জামাতে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান, কিশোরগঞ্জ পৌর মেয়র মাহমদু পারভেজসহ জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অংশ নেন।

নেত্রকোনার কলমাকান্দা থেকে গত ৫০ বছর ধরে এ মাঠে ঈদের নামাজ আদায় করছেন ফায়জুল ইসলাম (৭২)। তিনি ঈদের আগের রাত্রেই কিশোরগঞ্জে চলে আসেন। ছিলেন নিকট আত্মীয়ের বাসায়। তিনি বলেন, প্রতিবছরই আমি শোলাকিয়া ঈদগাহে নামাজ আদায় করে আসছি। আল্লাহ যতদিন জীবিত রাখবেন, চেষ্টা করব শোলাকিয়ার ঈদের জামাতে অংশ নিতে।

কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা ফারুক মিয়া (৪৫) ভোরে কয়েকজনকে সাথে নিয়ে রিকশাযোগে আসেন শোলাকিয়া মাঠে। প্রতিবছরই তারা এ মাঠে ঈদের জামাতে অংশ নেন। তিনি বলেন, একসঙ্গে লাখ লাখ মুসুল্লীদের মাঝে ঈদের জামাতে অংশ নেয়াও ভাগ্যের ব্যাপার। এখানে আসলেই অন্যরকম এক শান্তি খুঁজে পাই। তাছাড়া বড় জামাতে নামাজ আদায় করলে আল্লাহ তালাও মনের আশা পূরণ করেন। তাই বারবার ছুটে আসি এ শোলাকিয়া মাঠে। প্রতিবারের মতো আশাকরি ভবিষ্যতে এর কোন ব্যতয় ঘটবেনা।

শোলাকিয়া ঈদগাহ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, এবারও পাঁচ লাখের বেশি মুসল্লি শোলাকিয়ায় নামাজ আদায় করেছেন বলে আমাদের ধারণা। এবারের জামাতের ব্যবস্থাপনা ছিল খুবই ভাল। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে মুসল্লিদের।

মাঠের সুনাম ও নানা জনশ্রুতির কারণে ঈদের কয়েক দিন আগেই কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও সারাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শোলাকিয়ায় মুসল্লিদের সমাগম ঘটে। এদের অনেকেই উঠেছিলেন হোটেলে, কেউবা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ও শোলাকিয়া ঈদগাহ মিম্বরে।

শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে অংশগ্রহণকারী মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে দুটি বিশেষ ট্রেন চলাচল করে। একটি ট্রেন ভৈরব থেকে সকাল ৬টায় ছেড়ে আসে এবং সকাল ৮টায় কিশোরগঞ্জ পৌঁছায়। অন্যটি ময়মনসিংহ থেকে সকাল পৌনে ৬টায় ছেড়ে আসে এবং সকাল সাড়ে ৮টায় কিশোরগঞ্জ পৌঁছায়। নামাজ শেষে জামাতে আসা যাত্রীদের নিয়ে আবার গন্তব্যে ফিরে যায় ট্রেন দুটি।

দেশের বৃহত্তম এ ঈদ জামাতকে কেন্দ্র করে মাঠ পার্শ্ববর্তী এলাকায় হস্ত, কারু ও নানারকম শিল্পের মেলা মুসুল্লিদের জন্য ছিল অন্যতম আকর্ষণের বিষয়।

জনশ্রুতি আছে, ১৮২৮ সালে এই মাঠে ঈদের জামাতে সোয়া লাখ মুসল্লি এক সাথে নামাজ আদায় করেছিলেন। সেই থেকে এ মাঠের নাম হয় ‘সোয়া লাখিয়া’। যা এখন কালক্রমে শোলাকিয়া নামেই পরিচিত।

About admin

Check Also

তীব্র গরমে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রাথমিক-মাধ্যমিকে অনলাইনে ক্লাস চালুর চিন্তা

দেশে তীব্র তাপপ্রবাহে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দীর্ঘ ছুটি শেষেও খোলেনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গত ২১ এপ্রিল ছুটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *